হাউস অব ড্রাগন (House of ড্রাগন) অথবা গেইম অব থ্রোনস (Game of thrones) যেটাই হোক না কেন রাজসিংহাসন এর ষড়যন্ত্রের চেয়েও মানুষের নজর কেড়েছে অতিপ্রাকৃত এক জীব। ড্রাগন!!!
মুজের শিং, উটের মাথা, খরগোশের চোখ, সামুদ্রিক সাপের পেট, মাছের আঁশ, ঈগলের কাঁক, বাঘের হাতের তালু, গরুর কান, ছাগলের রুটি, সাপের দেহ সম্বলিত এই প্রাণীটির আদো কি কখোনো পৃথিবীতে এর বিচরণ ছিল? নাকি নিছকই কেবল মানুষের কল্পনাপ্রসূত কোন প্রাণী? ড্রাগন নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনা থাকলেও বিভিন্ন অঞ্চল ও সংস্কৃতি ভেদে ড্রাগনের রুপ এক এক রকম।
পশ্চিম বিশ্বে ড্রাগনকে আগুনের তৈরী বা শয়তানের চরিত্রে দেখানো হলেও চাইনিজ সংস্কৃতিতে ড্রাগনকে দেখা হয় বুদ্ধিমান, বন্ধুসুলভ ও সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে। অতিপ্রাকৃতিক আশ্চর্য এই প্রাণীটি উৎসব থেকে শুরু করে শিল্প, ছবি, নাম, জোতিষ বিদ্যা সহ চায়না সংস্কৃতির সর্বত্র জুড়ে রয়েছে। ড্রাগনকে চীনে শক্তি, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রতীক মানা হয়। তাদের ধারণা মতে পানি, বৃষ্টি, বন্যার উপর ড্রাগনের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
উৎপত্তি
প্রাচীন মিথোলজিতে হাজার বছর পূর্বে ইয়ানদি নামক এক শাসক এর জন্ম হয় তার মা আর ড্রাগনের ট্যালিপ্যাথিক যোগাযোগ এর মাধ্যমে। মিথে ইয়ানদির বিবরণ দেয়া হয়ে অর্ধ মানব হিসেবে যার মাথা ছিল ষাঁড়ের আর শরীর ছিল মানুষের। তার পাকতন্ত্র ছিল স্বচ্ছ অর্থাৎ যাই খেত তা হজম হয়ে যেত। ইয়ানদি ও হলুদ রাজার কন্যা হুয়ানদির, মধ্যকার সম্পর্ক এর মাধ্যমে চাইনিজ সম্প্রদায়ের সৃষ্টি বলে মনে করে তারা। তাই ইয়ানদি ও হুয়ানদিকে তারা নিজেদের প্রাচীন পূর্বসুরী মনে করে। সময়ের সাথে সাথে চাইনিজরা নিজেদের ড্রাগনের উত্তরসূরী বলে মনে করতে থাকে।
আরেক তথ্যে পাওয়া যায়, হাজার বছর পূর্বে যখন চায়না নামক কোনো দেশ ছিল না, তখন সে অঞ্চলের মানুষরা বিভিন্ন রকম উপজাতি হিসেবে বাস করত। সেখান কার শাসক ছিল যুয়ানহুয়ান হুয়ানদি বা হলুদ রাজা। হুয়ানদি শব্দের অর্থ হলুদ বা আলোকিত। তাই তাকে হলুদ রাজা বলা হত। সে সময় এক এক উপজাতি সম্প্রদায় এক এক প্রাণীকে নিজেদের প্রতীক ও উপাস্য হিসেবে বেছে নিত। কুমির, সাপ, ড় প্রভৃতি। উপকথা অনুযায়ী হলুদ রাজা ৩ টি বৃহৎ সম্প্রদায় ও ৭২ টি অন্যান্য সম্প্রদায়কে একত্রিত করার জন্য সব সম্প্রদায়ের উপাস্য প্রাণী গুলির প্রতীক একত্রিত করে একটি নতুন প্রাণীর প্রতীক তৈরী করেন। যার সর্পাকৃতির দেহ, দেহে মাছের মতন আঁশ, ঘোড়ার মতন মাথা, সিংহের নাক, ড়ের জিভ, ঈগলের থাবা, সাপের লেজ, হরিণের সদৃশ শিং, হাতির ন্যায় দাত; সব মিলিয়ে যার নাম রাখা হয় ড্রাগন।
অন্য তথ্যে পাওয়া যায়, একদা একটি শক্তিশালী উপজাতির বসতি ছিল হলুদ নদীর তীরে। তাদের প্রতীক ও উপাস্য ছিল সাপ। শক্তিশালী উপজাতিটি আশেপাশের অন্য উপজাতির গোষ্ঠীদের উপর অনেক গুলো যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তাদেরকে হারানোর পর সব সম্প্রদায়ের প্রতীক নিয়ে নিজস্ব আলাদা একটি সর্পাকৃতির প্রাণীর প্রতীক তৈরী করে। অদ্ভুত সে প্রাণীটির নাম দেন ড্রাগন।
সেই থেকে চায়নাতে ড্রাগনকে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। পরবর্তী শাসকরা নিজেদের “সত্যিকার ড্রাগন ও স্বর্গের পুত্র” হিসেবে আখ্যা দিত এবং চাইনিজরা নিজেদেরকে ড্রাগনের বংশধর বলে পরিচয় দেয়।
মিথোলজি
চায়না মিথোলজিতে ড্রাগনকে জলের প্রাণী হিসেবে মানা হয়। মিথ অনুযায়ী, ড্রাগনরা পানি ও আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে৷ চারজন ড্রাগন রাজা চায়নার সমুদ্র নিয়ন্ত্রণ করে, উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে। তাদেরকে বহুরুপী ও বলা হয়। রুপ বদল করে মানুষের রুপও ধারণ করতে পারে। তাদেরকে সবচেয়ে প্রাচীন ও বুদ্ধিমান ড্রাগন হিসেবে ধরা হয়।
সেসময় মানুষ প্রকৃতিকে ভয় পেত তাই আকাশে তারার অবস্থান থেকে বিভিন্ন পথ জতে থাকে প্রকৃতিকে চেনার। আকশের ২৮ টি তারাকে ৪ ভাগে বিভক্ত করে, যার প্রতি ভাগে পড়ে ৭ টি তারা। এই ৪ টি বড় গ্রুপ ছিল উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে৷ মানুষ গ্রুপের ৭ টি তারার মধ্যে সংযোগ করে ড্রাগনের আকৃতি দেখতে পেত। এভাবে উত্তর ড্রাগনের তারার গ্রুপ, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম ড্রাগনের গ্রুপ গড়ে ওঠে।
চায়নার মানুষের সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থান ছিল কৃষি। তারা ড্রাগনকে বৃষ্টির সাথে সংযুক্ত করে যা কৃষি ও খাদ্যের জন্য অপরিহার্য। যখন বজ্রপাত সহ বৃষ্টি হয় তারা বিশ্বাস করে ড্রাগন বৃষ্টিপাত ঘটাচ্ছে আর বজ্রপাত হল ড্রাগনের গর্জন। এজন্য ড্রাগনকে তারা লং ও বলে যা চায়নাদের মতে বজ্রপাতের ধ্বনির সাথে মিল রয়েছে।
বর্তমানে চায়নায় ড্রাগন সংস্কৃতি
বর্তমানে ড্রাগনের আকৃতিতে কিছু পরিবর্তন এসেছে। পূর্বে ড্রাগনের থাবায় আংগুল ছিল মাত্র দুইটি। কালের বিবর্তনে তা তিনটি, চারটি হয়ে বর্তমানে পাঁচটি হয়েছে। ইউয়ান রাজত্ব থেকে পাঁচ নখর বিশিষ্ট ড্রাগনের প্রতীক ব্যাবহৃত হয় শুধু মাত্র রাজার ক্ষেত্রে, রাজপুত্রের ক্ষেত্রে চার নখর বিশিষ্ট ড্রাগন প্রতীক ব্যাবহৃত হয়।
চায়নার প্রধান চারটি প্রতীকের মধ্যে অন্যতম হল ড্রাগন, বাকি গুলো হল সাদা বাঘ, কালো কচ্ছপ, বাজপাখি বা ফিনিক্স পাখি। এই চারটি প্রতীক চারটি দিক ও চারটি মৌসুমকে ইংগিত করে।
চাইনিজ ১২ টি জোত্যিস চিন্হের মধ্যে ড্রাগন একটি, অন্যগুলো হল, ইদুঁর, ষাড়, বাঘ, খোরগোশ, সাপ, ঘোড়া, ভেড়া, বানর, মোরগ, কুকুর ও শুকর।
৯ সংখ্যাটি কেন চাইনিজদের এত প্রিয়!
চায়নাদের প্রাচীন মিথোলজিতে হলুদ রাজা তার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতীক থেকে তৈরী ড্রাগনটিকে নিয়ে স্বর্গের দিকে চলে যায় নবম চন্দ্রমাসের নবম দিনে। “আটটি ডায়াগ্রামের” অবস্থান অনুযায়ী ইয়ান রাজত্ব এর অবস্থান নবম। তাই ডাবল নাইন সংখ্যাটি চাইনিজদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বছরের এই দিনে চাইনিজরা উপরের দিকে উঠে এবং দেখার আশা করে যে হলুদ রাজা আবার ড্রাগনে চড়ে ফিরে আসবে।
রঙ অনুসারে ড্রাগনের রকমফের
লাল ড্রাগন : লাল চায়নার সৌভাগ্যশালী রং। সাধারণত বিভিন্ন বিয়ে বা উৎসবে সাজাতে লাল ড্রাগনের প্রতীক ব্যবহৃত হয়। ড্রাগন নৃত্যের জন্য লাল ড্রাগন ব্যবহার করার প্রথা রয়েছে।
কালো ড্রাগন : কালো চাইনিজ ড্রাগন হল প্রতিশোধপরায়ণতার রুপক। চাইনিজ মুভিতে সন্ত্রাসী সংস্থা বা রাস্তার গুন্ডাদের দলকে কালো ড্রাগন প্রতীক ব্যবহার করতে দেখা যায়। তাদের বাহুতে বা পিঠে কালো ড্রাগনের ট্যাটু করা থাকে যা শয়তান বা প্রতিশোধ এর চিন্হ বুঝায়। প্রাচীন চাইনিজ মিথে কালো ড্রাগনকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগ যেমন ঘূর্ণিঝড় বা বন্যার সাথে সম্পৃক্ত করা হত।
সাদা ড্রাগন : সাদা রঙ প্রথাগতভাবে মৃত্যু ও শোকের রঙ হিসেবে বিবেচিত হয় চায়না সংস্কৃতিতে। যদিও সাদা ড্রাগন সততা ও পবিত্রতার সাথে সম্পৃক্ত।
নীল ও সবুজ ড্রাগন :
চায়না সংস্কৃতিতে নীল ও সবুজ রঙ প্রকৃতি, স্বাস্থ্য, সুস্থতা, শান্তি এবং আধিক্যের নির্দেশক। তেমনিভাবে নীল বা সবুজ ড্রাগন বসন্তকাল, নতুন জীবন ও বৃদ্ধির প্রতীক।
হলুদ ড্রাগন :
প্রাচীন শাসন আমল থেকেই চায়নায় হলুদ রঙ কে রাজকীয় রঙ হিসেবে গণ্য করা হয়। হলুদ ড্রাগন রাজার প্রতীক। এটি বুদ্ধিমত্তা, সৌভাগ্য এবং ক্ষমতাকে নির্দেশ করে।
সোনালী ড্রাগন :
সোনালী ড্রাগন এর সাথে শক্তিশালী দেবতা বা কৃষির সম্পৃক্ততা রয়েছে। এটি সদা ধনসম্পদ, উন্নতি, শক্তি, কৃষি এবং ক্ষমতার প্রতীক।
চাইনিজ ড্রাগন ভার্সেস ওয়েস্টার্ন ড্রাগন
চায়নাতে ড্রাগনকে মূলত বুদ্ধিমান, দয়ালু ও সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে দেখানো হলেও পশ্চিমা দেশগুলোতে ড্রাগনকে মূলত শয়তানের রুপক হিসেবে দেখানো হয়। অনেকের ধারণা বাইবেলে সাপকে শয়তানের রুপক বলা হয়েছে, আর যেহেতু ড্রাগন সরীসৃপ শ্রেণির তাই বিভিন্ন মুভিতে ড্রাগনকে ভিলেন, রক্তপিপাসু ও শয়তানের প্রতিরুপ দেখানো হয়।
সিনেমায় ড্রাগন
গেইম অফ থ্রোনস মুভিতে নায়িকা ডায়নেরিসের তিনটি ড্রাগন ছিল যা সে উপহার হিসেবে পেয়েছিল। তিনটির নাম হল ড্রোগোন, রিগ্যাল এবং ভিসেরন। ড্রোগোনের রঙ ছিল কালো ও লাল, রিগ্যাল ছিল সবুজ ও ব্রোঞ্জ কম্বিনেশনের ড্রাগন এবং ভিসেরনের রঙ ছিল সোনালী ও ক্রিম। তিনটি ড্রাগনই ছিল অগ্নি নির্বাপক।
হ্যারি পটার সিরিজের গবলেট অফ ফায়ার মুভিতে ট্রাই উইজার্ড টুর্নামেন্টের প্রথম ধাপে প্রতিযোগীদের ড্রাগনের সাথে মোকাবিলা করতে দেখা যায়। চার জন প্রতিযোগী চারটি ড্রাগন মোকাবিলা করে। হাংগারীয়ান হর্ণটেইল, চাইনিজ ফায়ারবল, সুইডিশ শর্টনট এবং ওলেশ গ্রিন। প্রতিটি ড্রাগনকেই ভয়ংকর রুপে দেখানো হয় যারা শুধুই আগুন দিয়ে ভষ্ম করার প্রয়াস চালায়।
একটু খেয়াল করলে লক্ষ্য করা যায় সাপ, শয়তান, জাদুকরের জাদু, মানুষের বলি, তন্ত্রমন্ত্রের মত বিভিন্ন ডার্ক ম্যাজিকের সাথে ড্রাগন সংযুক্ত। স্যাটানিক বিভিন্ন প্রথা প্রতক্ষ্য বা পরোক্ষভাবে ড্রাগনকে ঘিরে পালন করা হয়৷
চায়নায় দেখা যায় বিপরীত চিত্র, ড্রাগনকে সিনেমায় দেখানো হয় জ্ঞানী, বন্ধু ভাবাপন্ন, শক্তিশালী ও দেবতাতুল্য। যুগ যুগ ধরে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে ধারণ করা ড্রাগনের জনপ্রিয়তা চায়নায় তাই তুঙ্গে।
Leave a Reply