ট্রেন টু বুসান এর শেষ দৃশ্য দেখে গাল বেয়ে চোখের পানি পড়া বা অল অফ আজ আর ডেড দেখে চমকে যাওয়া মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয় কখনো কি ভেবে দেখেছেন মানুষ রূপী এই জম্বি গুলো যারা ঠিক জীবিতও নয় আবার মৃতও নয় এমন অদ্ভুতূড়ে থিওরির উৎস কি? কিভাবে মানুষ থেকে জম্বি সৃষ্টি হয়? আদৌ কি বাস্তবে জম্বি বলে কিছু আছে?
জম্বি কি
জম্বি শব্দ প্রথম কোথায় উঠে এসেছে তার সময় নিয়ে ধোয়াশা থাকলেও ধরে নেয়া হয়, রবার্ট সাউদি ৩০০ বছর আগে জম্বি শব্দটি ব্যাবহার করেন তার বই “হিস্টোরি অফ ব্রাজিল” এ। শব্দটি এসেছে পশ্চিম আফ্রিকার একটি অংশ থেকে, যা বর্তমানের নাইজেরিয়া দেশ। ইংরেজি শব্দ জম্বি(Zombie) হাইতিয়ান ফারসি ভাষা ‘Zombi’ বা হাইতি ক্রেওল ভাষা ‘Zonbi’ থেকে এসেছে। জম্বি বলতে মূলত এমন এক ধরনের মানুষকে বোঝায় যে মারা যাওয়ার পরও অতিপ্রাকৃতিক কালো জাদুমন্ত্র বলে জীবিত রুপে ফিরে আসে কিন্তু তার নিজস্ব কোনো বিচার বুদ্ধি থাকে না, মন্ত্র দ্বারা তাদের যা করানো হয় তারা ঠিক তেমনটিই করে।
জম্বির ইতিহাস
বিশ্বের সিনেমা নির্মাণের অন্যতম জনপ্রিয় বিষয়বস্তু হল জম্বি। শুধু সিনেমা নয় গেইম, লোগো, স্টিকার নানা জিনিসে জম্বি এখন বিস্তার করছে। হাউজ অফ দ্যা ডেড, প্লান্ট ভার্সেস জম্বি গেইম খেলে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেয় নি এমন আজকালকার ছেলে মেয়ে মেলা দুষ্কর।
হলিউড, বলিউডের দেওয়া জম্বির ধারণা থেকে মূল জম্বির ধারণা অনেক খানি আলাদা। আর এই ধারণার সূচনা সুদূর হাইতিতে প্রথম খুজে পাওয়া যায়। হাজার বছর ধরে চলা জম্বি উপকথার শুরু ১৭ শতকের দিকে, যখন হাইতি ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল এবং এই অঞ্চলের নাম ছিল সেইন্ট ডোমাংগ। হাইতিতে আখ বাগান ও চিনিকলে চাষের জন্য পশ্চিম আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের কৃতদাস হিসেবে ধরে আনা হত। সেসব দাসদের উপর নির্যাতনের মাত্রা এতই বেড়ে যায় যে মৃত্যুই তখন তাদের মুক্তির একমাত্র পথ মনে হতে থাকে। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই অনেক মানুষ মারা যায়। তারা বিশ্বাস করত মৃত্যুর পর তারা আবার তাদের নিজেদের জন্মভূমিতে ফিরে যাবে। কিন্তু আত্মহত্যা করলে পুনর্জন্ম আর সম্ভব নয়। আত্মহত্যার ফলাফল স্বরূপ শাস্তি হিসেবে আজীবন দেহ খাচায় আত্মা বন্দি করে রাখা হবে। জম্বির ধারণা মূলত এইখান থেকেই এসেছে যেখানে জম্বি বলতে জীবিত, মৃতের মাঝামাঝি এক অবস্থায় থাকা মানুষকে বোঝানো হয়।
জম্বির কথা প্রথম পশ্চিমা দেশে উঠে আসে উইলিয়াম সিব্রুকের বই ” দ্যা ম্যাজিক আইসল্যান্ড” এর মাধ্যমে। এটিই প্রথম কিছু যা হাইতির জম্বি ধারণা পশ্চিমা দেশে তুলে ধরে লেখকের গল্পের ছলে এবং তা জনপ্রিয় হয়ে উঠে। সিব্রুক হাইতিকে একটি কাল্পনিক জগৎ এর মত উপস্থিত করেন যেখানে দাসত্ব, দারিদ্র্য ও পুরোনো কুসংস্কারের আখড়া। সিব্রুকের লেখনীর দেখানো পথে জম্বি ধারণার প্রবেশ ঘটে হলিউডে। হলিউডের প্রথম দিক কার সিনেমাতে তাই জম্বিদের দেখানো হয় ভুডু মাস্টারের হাতের পুতুল বা কৃতদাস লাশের ন্যায়। পশ্চিমে জম্বি নামক অদ্ভুতূড়ে প্রাণীর খ্যাতি এতই ছড়িয়ে পড়ে যে জম্বির প্রকৃত পরিচয় যার মাঝে মিশে রয়েছে পশ্চিমাদের নির্যাতন ও জোরপূর্বক দাসত্বের ইতিহাস তা পুরোপুরি চাপা পড়ে যায়। জোয়ান ডায়ান তার ” হাইতি, হিস্টোরি অ্যান্ড দ্যা গডস” বইয়ে হাইতি ভুডু ধর্মের আলোকে তাদের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে কৃতদাসত্ব ও জম্বি মিথের ব্যাখ্যা দেন। এখানে হাইতির উপর আমেরিকার ১৯১৫ থেকে ১৯৩৪ পর্যন্ত দখলদারত্বেরও বর্ণনা রয়েছে যা জম্বি মতবাদের সাথে সম্পৃক্ত। বইয়ে জম্বিকে হতাশা, অসহায়, নির্জীব, নিথর মানুষের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছে যারা উপনিবেশ বাদীদের অত্যাচারে পরাধীন। ডায়ানের লেখনীতে ফুটে ওঠে কিভাবে তারা স্বাধীন হতে চায় কিন্তু আবার মৃত্যুর আগের ও পরবর্তী জীবনের মাঝামাঝি অবস্থা, অর্থাৎ জম্বি হতে ভয় পায়৷
ভুডু
জম্বির অন্যতম মূল ভুডু ধর্মের সাথে সম্পর্কিত। হাইতিতে আনা আফ্রিকান দাস দের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মিশ্রনের থেকে উদ্ভব হয় ভুডু ধর্মের। কৃষাঙ্গ আফ্রিকান কৃতদাসরা বিশ্বাস করত জম্বি ভুডু ধর্মের অনুসারী তান্ত্রিকের মন্ত্র থেকে তৈরি। এ ধরনের তান্ত্রিকদের বলা হত ‘বকর’। এসকল তান্ত্রিকরা বিভিন্ন বস্তু যেমন পশুর শরীরের অংশ, ভেষজ লতাপাতা, মৃত ব্যাক্তির হাড্ডি, অংগ প্রত্যংগ এবং অন্যান্য জিনিস মিশিয়ে ‘জম্বি পাউডার’ নামক এক ধরনের মিশ্রণ বানাত যা তন্ত্রসাধনায় ব্যবহার করে তারা মৃত ব্যক্তিকে আবার জম্বি রুপে জীবিত করে তুলত। পরবর্তীতে ভুডু পাউডার নিয়ে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে আসে এক বিষাক্ত উপকরণের নাম। নিউরোটক্সিন বা যাকে টেট্রোডোটক্সিন ও বলা হয় যা মূলত পাফার মাছ এবং অন্য কিছু প্রাণীতে পাওয়া যায়। টেট্রোডোটক্সিন ভিকটিমের শরীরে প্রবেশ করে মস্তিষ্কের পরিবর্তন করে মানসিক বিপর্যয় ঘটায়, শ্বাসকষ্ট হয় এমনকি সাময়িক প্যারালাইজড হওয়া থেকে শুরু করে কমা পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে এই ঘাতক উপকরণ। টেট্রোডোটক্সিনের প্রভাবে ভিকটিমের হাটতে চলতে অস্বাভাবিকতা সৃষ্টি হয়। মস্তিষ্কে হ্যালুসিনেশন সৃষ্টির ফলে নিজস্ব চিন্তাশক্তি লোপ পায়। এ প্রক্রিয়ার নাম দেওয়া হয় জম্বিফিকেশন। হাইতিতে জম্বিফিকেশন এতই আশংকাজনক হারে বেড়ে গিয়েছিল যে পরবর্তীতে তা আইনের মাধ্যমে প্রতিরোধ করতে হয়েছে। হাইতির পেনাল কোড ২৪৯ আর্টিকেল অনুসারে কেউ যদি জম্বি তৈরি করতে চায় তবে তা হত্যাচেষ্টা পরিগণিত হবে এবং জম্বি করার উদ্দেশ্যে কাউকে কবর দেয়া হলে তা খুন হিসেবে বিবেচ্য হবে ও সে অনুযায়ী শাস্তি প্রদান করা হবে।
জম্বির সত্যিকার কেইস
ক্লাইরভিয়াস নারসিসকে ১৯৬২ সালের মে মাসের ২ তারিখে আলবার্ট সুইটজার হাসপাতালে মৃত ঘোষণা করা হয়। পরের দিনই তাকে কবর দেয়া হয় এবং ১০ দিন এর মধ্যেই তার কবরে মেমোরিয়াল স্ল্যাব বসানো হয়। ১৯৮০ সালে আশ্চর্যজনকভাবে সে তার নিজের গ্রামে ফিরে আসে। সে তার বোন এঞ্জেলিনাকে খুজে পায় এবং নিজের পরিচয়ের প্রমাণ সরুপ সে নিজের এমন এক নাম বলে যে নামে শুধু তার পরিবার তাকে সম্মোধন করত। সে দাবি করে তাকে জম্বিফিকেশন করা হয়েছে।
আরেকটি ঘটনায় দেখা যায়, হাইতিয়ান একজন নারী মারা যাওয়ার পর পারিবারিক কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। তিন বছর পর সেই নারীটি আবার জীবিত ফিরে আসে। মানুষ কৌতুহলী হয়ে তার কবর অনুসন্ধান করলে কবরে শুধু পাথর পাওয়া যায়। পরবর্তীতে তার পরিবার তাকে হাসপাতালে চেক আপের জন্য নিয়ে যায়।
সিনেমায় জম্বি
প্রথম ইংরেজি সাহিত্যে জম্বির কথা তুলে ধরা হয় ১৭শ শতকে। তখন জম্বি কে মূলত ভূতূড়ে বা কৃতদাস আত্মা হিসেবে দেখানো হত। পরবর্তীতে হলিউড পপ কালচারের সাথে এই ধারণার পরিবর্তন হয়ে তা মাংস খেকো জম্বিতে পরিণত হয়। বর্তমান সিনেমাতে বৈজ্ঞানিকভাবে জম্বির মূল ভিত্তি দেখানোর জন্য এটির মূল উৎস দেখানো হয় ল্যাবে নির্মিত কোনো ভাইরাস যা মস্তিষ্কে বিরুপ প্রভাব সৃষ্টি করে মানুষকে অর্ধ মৃত করে দেয়।
যেমনটি আমরা দেখতে পাই ‘অল অফ আজ আর ডেড’ সিনেমাতে। যেখানে একজন স্কুল শিক্ষকের ভুল গবেষণার ফলে সৃষ্টি হয় এক মরণঘাতী ভাইরাস যা মানুষের মস্তিষ্কে দ্রুত বিক্রিয়া করে তাকে মাংস খেকো ভয়ংকর জম্বিতে পরিণত করে ফেলে। জম্বির সামান্য আচড় বা কামড় থেকেও যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ সেকেন্ডারি জম্বিফিকেশন বা দ্বিতীয় পর্যায়ের জম্বি হওয়ার প্রক্রিয়া হচ্ছে ছোয়াচে। অন্যান্য সিনেমাতে দেখানো হয় কোনো বিষাক্ত দুর্লভ গাছের পাতা গ্রহণের ফলে জম্বি সৃষ্টি হয়। বর্তমানে বেশির ভাগ সিনেমাতে জম্বিকে মাংস খেকো, খুনি এবং ছোয়াচে এক মানসিক বিকৃতি হিসেবে দেখানো হয়। কোন কোন ফিকশন সিনেমা এমন ও প্রদর্শিত হয় যে জম্বি সহজে মরণশীল নয়, নির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতিতেই কেবল এই ভয়ংকর খুনী জম্বিদের মারা সম্ভব। এক এক সিনেমাতে এক এক রকমের বৈশিষ্টের জম্বির প্রদর্শন দেখা যায়। তবে সবকটিই সত্যিকার জম্বির প্রাচীন মূল ভিত্তি থেকে বহুদুরের।
Leave a Reply