হ্যারি পটার সিরিজের শেষ দুই পর্বে দেখা যায়, হ্যারি পটার ও তার দুই বন্ধু রন এবং হারমিয়ন কখোনো ছুটে চলেছে বন বাদাড়ে কখোনো বা ভয়ংকর জংগলে ভোল্ডেমর্ট এর লুকানো হরক্রাক্স এর সন্ধানে। কি এই হরক্রাক্স? ভোল্ডেমর্টকে ধ্বংস করতে হলে কেনই বা এর প্রয়য়োজন?গল্পের এই হরক্রাক্সের ধারণা বাস্তবে লেখিকা জে.কে. রাওলিং এর মাথায় আসলই বা কোত্থেকে?
হ্যারি পটার ইউনিভার্সে জে.কে. রাউলিং তার পাঠকদের জাদুর দুনিয়ার অনেক ধরনের উপকরণের সাথে পরিচিত করিয়েছেন। এদের মধ্যে অন্যতম রহস্যময় ও আশ্চর্যজনক উপকরণ হল হরক্রাক্স। কিন্তু এটি এমনই একটি মিস্ট্রি যে লেখক খোদ নিজেও পুরো ব্যাপারটি পরিস্কারভাবে বিষয়টি বর্ণনা করেন নি।
হরক্রাক্স কি:
অমরত্ব লাভের চেষ্টা মানুষের যুগ যুগ ধরে। হ্যারি পটারে কালো জাদুকরেরা এই অমরত্ব লাভের জন্য কোনো বস্তুর মধ্যে তাদের আত্মার একটি খন্ডিত অংশ লুকিয়ে রাখত।যতক্ষণ পর্যন্ত আত্মার ঐ খন্ডিত অংশ অক্ষত থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই জাদুকর অমর হয়।এভাবে আত্মা খন্ডন করে খন্ডিত আত্মা অন্য কোনো বস্তুর ভেতর সংরক্ষণ করা হলে সেই বস্তুটিকে বলা হয় হরক্রাক্স। এই হরক্রাক্স তৈরী জাদু জগতে একটি আইন বিরোধী কাজ কারণ এখানে মৃত্যুর মত স্বাভাবিক বিষয়কে উলংঘন করার প্রচেষ্টা করা হয়। যে কোন কিছুই হরক্রাক্স হতে পারে, কিন্তু হরক্রাক্সের জন্য নিষ্প্রাণ বস্তুই বেশি উপযুক্ত। কারণ যার প্রাণ আছে এমন কিছুকে হরক্রাক্স বানানো হলে সে মারা গেলেই, তার ভিতরকার আত্মার অংশটুকুও ধ্বংস হয়ে যাবে৷ তাই নির্জীব বস্তুকে হরক্রাক্স বানানোর সময় কঠিন মন্ত্র দ্বারা প্রতিরক্ষা দেয়া হয় যেন তা প্রচন্ড শক্তিশালী জাদুকরের জন্যও ধ্বংস করা অনেক কঠিন হয়।
মৃত্যুই স্বাভাবিক ও প্রকৃত সত্য। অমরত্বের মত অস্বাভাবিক বিষয়টি আয়ত্ত করতে তাই নিষিদ্ধ কালো জাদুর সাহায্য নেয় হ্যারি পটার সিরিজের কালো জাদুকরেরা। তাদের মধ্যে শুধুমাত্র ভোল্ডেমর্টই একমাত্র জাদুকর যে তার আত্মাকে একাধিক ভাগে ভাগ করে হরক্রাক্সে সফলভাবে পরিণত করতে পেরেছিল।
“হ্যারি পটার এন্ড দ্যা হাফ ব্লাড প্রিন্স” পর্বে পাঠকরা জানতে পারে যে টম রিডল যে কিনা পরবর্তীতে ভল্ডেমর্ট নামে পরিচিত হয়, হরক্রুক্সের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠে এবং প্রফেসর হোরাস স্লাগহর্ণের কাছে গোপনে এই ব্যাপারে জানতে চায়৷ প্রফেসর টম রিডলকে হরক্রাক্স সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে বুঝিয়ে বলে। ভালোমতো বুঝার পর টম রিডল যখন জানতে চায় যে একাধিক হরক্রাক্স বানানো সম্ভব কিনা, যা প্রকৃতির নিয়মের চরম লংঘন ও পৈশাচিক। প্রফেসর স্লাগহর্ণ তখন টম রিডলের কুচিন্তার ব্যাপারে আন্দাজ করে ভীত হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে তাকে হরক্রাক্সের মত নিষিদ্ধ বিষয়ে জানানোর জন্য অনুতাপে ভোগেন।
ভোল্ডেমর্টের হরক্রাক্সের তালিকা:
ভোল্টেমর্ট তার আত্মাকে অনেকগুলো ভাগে বিভক্ত করতে সক্ষম হন। তার হরক্রাক্স ছিল সবমিলিয়ে ৭ টা৷ এগুলো হল, তার ডায়েরি, মারভোলো গাউন্টের আংটি, স্লিদারিনের লকেট, হাফলপাফের কাপ, রোয়িনা রেভেনক্ল এর মুকুট,ব্যাসিলস্ক সাপ নাগিনী ও হ্যারি। শেষের হরক্রাক্সটি ভোল্ডেমর্ট যখন হ্যারির বাবা মা কে মারার পর যখন হ্যারিকে হত্যা করতে যায় তখন ভুলক্রমে তৈরি হয়ে যায় অর্থাৎ হ্যারিকে ভুলক্রমে সে হরক্রাক্স এ পরিণত করে। এর মধ্যে নাগিনী ও হ্যারিই ছিল জীবিত হরক্রাক্স।
হরক্রাক্স বানানোর প্রক্রিয়া :
হরক্রাক্স বানানোর নিষিদ্ধ প্রক্রিয়া ‘দ্যা সিক্রেটস অফ দ্যা ডার্কেস্ট আর্ট’ বইটিতে উল্লেখ করা ছিল। বই টি লাইব্রেরির রেস্ট্রিকটেড অংশে ছিল, পরবর্তীতে ডাম্বেলডোর প্রধান শিক্ষক হওয়ার পর তিনি সেখান থেকে বইটি সরিয়ে ফেলেন৷ কিন্তু এর বহু আগেই ভল্ডেমর্ট এই বইটি থেকে কারসাজি করে হরক্রাক্স বানানোর পুরো প্রক্রিয়াটি জেনে নেয়।
প্রক্রিয়াটির কিছু অংশ সিনেমা থেকে বইতে অন্তত বেশ ভালোমত দেয়া আছে। হরক্রাক্স বানানোর জন্য প্রথম ধাপে একটি হত্যাকান্ড প্রয়োজন, কারণ এটিই সবচেয়ে জঘন্য শয়তানি কাজ হিসেবে বিবেচিত। দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে মন্ত্র। হত্যার পর দেহ থেকে আত্মা বিছিন্ন হয়ে গেলে মন্ত্রের মাধ্যমে আত্মাকে কয়েক ভাগে ভাগ করে বিভিন্ন জিনিস যা হরক্রাক্স বানানোর জন্য মনোনীত করা হয়েছে তাতে প্রবেশ করানো হয়। সর্বশেষ ধাপ এখনো রহস্য। বলা হয়ে থাকে এটি অতি পৈশাচিক একটি পর্ব যা হত্যাকাণ্ডের পরপরই কার্যসিদ্ধ করতে হয়। সর্বশেষ ধাপটির প্রক্রিয়া রহস্যময় ও অজানা রেখে দেওয়া হয়েছে যা হ্যারি পটার ফ্যানদের মধ্যে অনেক থিওরির জন্ম দিয়েছে বছরের পর বছর।
জে.কে. রাওলিং বলেছেন হরক্রাক্স বানানোর জন্য সর্বশেষ ধাপের ক্রিয়াটি এতই পৈশাচিক যে তার লেখার সে অংশটি পড়ে তার এডিটরই অসুস্থ অনুভব করেছিল তাই তিনি প্রক্রিয়াটি প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন৷
ফ্যানদের মধ্যে এমন থিওরি উদ্ভাবিত হয় এবং লেখক এ ব্যাপারে কিছু ইংগিত দেন যা ক্যানিবালিজমের দিকে নির্দেশ করে। ক্যানিবালিজম হল একই প্রজাতির অন্য প্রাণীকে ভক্ষণ অর্থাৎ একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে খাদ্য হিসেবে ভক্ষণ করাই ক্যানিবালিজম। ক্যানিবালিজম কালো জাদুবিদ্যার অন্যতম নিকৃষ্ট একটি প্রক্রিয়া যা দ্বারা মৃত ব্যাক্তির শক্তি, ক্ষমতা এমনকি স্বাস্থ্য নিজের মধ্যে নিয়ে নেয়া যায়। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ক্যানিবালিজম ধারণার প্রচলন হাজার বছর ধরে রয়েছে। উদাহরণ স্বরুপ গ্রীক মিথোলজিতে ক্রোনাস( সময়ের দেবতা) নিজের সন্তানদের খেয়ে ফেলত, তার ধারণা ছিল তার সন্তানদের মধ্যে একজন তাকে মেরে ফেলবে।
হ্যারি পটার সিরিজের কাহিনি নরখাদকের সাথে ডাইনীবিদ্যার সাথেও সম্পর্কিত। মধ্যযুগে প্রচুর ডাইনীবিদ্যার প্রচলন ছিল, যার দ্বারা জীবিত মানুষ নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য জাদুবিদ্যা দ্বারা মৃত ব্যাক্তির সাথে সংযোগ স্থাপন করত এবং নিজের কাজে লাগাত৷ বলা হয়ে থাকে, হরক্রাক্স তৈরীর সর্বশেষ রহস্যময় ধাপটি সম্ভবত খুনের শিকার হওয়া মানুষের মাংশ অথবা রক্ত খাওয়ার সাথে সম্পৃক্ত যাতে মৃত ব্যাক্তির শক্তি পাওয়া যায় এবং সদ্য ঘটানো হত্যাকান্ডের সাথে সম্পর্ক তৈরী হয়। এইভাবে হত্যাকান্ডটি জাদুকরকে হরক্রাক্স বানাতে সাহায্য করে।
লেখিকা জে.কে. রাওলিং বইয়ে ‘মার্টেল ওয়ারেন’ বা ‘শোকাহত মার্টেল’ নামক চরিত্রের দ্বারা এই ধারণাকে সত্য প্রমাণ করে।
১৯৪২-৪৩ স্কুল বছরে ষোল বছর বয়সী টম রিডল যখন হোগার্টসে, স্লিদারিন হাউসে ছিল তখন সে জানতে পারে যে সে নিজেই সালাজার স্লিদারিনের সর্বশেষ সরাসরি বংশধর। রিডল, সালাজার স্লিদারিনের পুরোনো ডায়েরি পড়ে চেম্বার অফ সিক্রেটস সম্পর্কে জানতে পারে, যেখানে লুকানো রয়েছে দানব আকৃতির এক ব্যাসিলিস্ক সাপ। এই চেম্বারটি শুধুমাত্র কোনো স্লিদারিনের যোগ্য বংশধরই খুলতে পারবে। টম পুরো স্কুল খুজে অবশেষে স্কুলের দ্বিতীয় তলায় মেয়েদের ওয়াশরুমের নিচের মেঝেতে এর লুকায়িত প্রবেশ পথ খুজে পায় এবং পার্সিলং টাং ভাষায় এর ভিতরে থাকা ব্যাসিলিস্ক সাপকে হুকুম দেয় মাগলবর্ণ স্টুডেন্টদের ভয় দেখাতে ও আক্রমণ করতে, যার ফলাফল মার্টেলের মৃত্যু। ব্যাসিলিস্ক মার্টেলকে হত্যা করেছিল তাই মার্টেলের সাথে টমের সরাসরি সম্পর্ক ছিল না। আর যেন হরক্রুক্স বানানো যায় তাই মার্টেলের হত্যার সাথে টমের সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য শুধু একটাই উপায় ছিল, যা ছিল মার্টেলের শরীরের কোনও একটি অংশ ভক্ষণ করা। জাদুবিদ্যা সমর্থিত নরখাদকই একমাত্র তৃতীয় ধাপের পৈশাচিক ক্রিয়ার উৎকৃষ্ট জবাব হতে পারে। কিন্তু তাতেও প্রশ্ন থেকে যায়। ভল্ডেমর্ট এর হরক্রাক্স বানানোর জন্য যাদেরকেই হত্যা করা হয়েছে তাদের শরীরে কোনো দাগ বা ক্ষতির চিন্হ ছিল না। বইয়ের ভাষ্যমতে সকল ভিকটিমদের শরীর একদম অক্ষত ছিল এবং তাদের চেহারায় প্রচন্ড মৃত্যু ভয়ের ছাপ ছিল। এর একটাই জবাব হতে পারে, ভল্ডেমর্ট প্রচন্ড রকম শক্তিশালী, বুদ্ধিমান ও দক্ষ জাদুকর ছিল। তাই এমনটা হওয়াও অসম্ভব না যে সে ভিক্টিমের হ্রদয় বা মস্তিষ্ক অথবা রক্ত খেত এবং মন্ত্রের মাধ্যমে ভিক্টিমের শরীরকে আবার বাইরে থেকে অক্ষত দেখানোর মত করে রেখে যেত। যাতে করে কেউ না বুঝতে পারে যে শরীরটিকে হরক্রাক্স বানানোর কাজে লাগানো হয়েছে। কালো জাদুবিদ্যায় রক্ত ও মাংশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি জিনিস যা জাদুকরদের মৃতদের থেকে শক্তি নিতে সাহায্য করে।
হরক্রাক্স বানানোর সর্বশেষ রহস্যময় ধাপটি অজানা থেকে যাওয়াও এক রকম ভালো। হ্যারি পটারের রোমাঞ্চকর রহস্যময় অনুভূতি যেন এসকল রহস্যময় বিষয়ের সাথে আজও টিকে আছে এবং ভল্ডেমর্টের ঐতিহ্যও টিকিয়ে রেখেছে যার কথা মনে হলে এখনো মনে হয় সবচেয়ে শক্তিশালী পৈশাচিক ভিলেন যে কিনা নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য যে কোনো ভয়ংকর অপরাধ, যে কোন সময় করতে পারে।
Leave a Reply