৩০০০ বছর পূর্বের অলিম্পিকের ইতিহাস ও বর্তমান

‘ দ্যা গ্রেটেস্ট শো অন দ্যা আর্থ’।  শোনার সাথে সাথেই অনুমান করে নেয়া যায়, কথা হচ্ছে অলিম্পিক নিয়ে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসর অলিম্পিক একটি আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা যা প্রায় দুই শতাধিক দেশের অংশগ্রহণের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়। এটিই পৃথিবীর একমাত্র জনপ্রিয় আসর যেখানে এতগুলো দেশের অংশগ্রহণে সারা বিশ্ব মুখরিত থাকে। আলোচনা, সমালোচনা, বানিজ্য, খবর, মিলনমেলা, ভ্রাতৃত্ব সবমিলিয়ে পৃথিবীর এতগুলো দেশের এক বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত হওয়ার জন্য এক বিশাল আয়োজন। অলিম্পিক গেমস দুই ভাগে হয়, একটি গ্রীষ্মকালীন এবং অপরটি শীতকালীন যা প্রত্যেক দুই বছর পর একটি হয়ে থাকে।

অলিম্পিক গেমস; Image Source: Store Norske Leksikon

অলিম্পিক গেমসের প্রাচীন ইতিহাস :

অলিম্পিক গেমসের গোড়াপত্তন প্রায় ৩০০০ বছর পূর্বে।  সময়টা যখন ৭৭৬ খৃষ্টাপূর্বাব্দ, তখন থেকে শুরু করে ৩৯৩ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ১২০০ বছর প্রাচীন গ্রীসের এলিস প্রদেশের অলিম্পিয়া নামক স্থানে অলিম্পাস পাহাড়ের পাদদেশে অলিম্পিক গেমসের আয়োজন হত। প্রাচীন গ্রীস অনেক গুলো রাজ্যে বিভক্ত ছিল। তাদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই থাকত। কিন্তু সে রাজ্যগুলোর মানুষের ধর্ম একই ছিল, সকলেই গ্রীক দেবতা জিউসের উপাসনা করত। প্রাচীন গ্রীক দেবতা জিউসের মন্দির ছিল অলিম্পিয়ায়।  মন্দিরের পূজারিদের তত্ত্বাবধানে গ্রীক দেবতা জিউসের সম্মানার্থে চার বছর পর পর অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হত। সে সময় এই প্রতিযোগিতাটি এতই জনপ্রিয় হল যে রাজ্যগুলো অলিম্পিক প্রতিযোগিতার সময় নিজেদের ভেতরে যুদ্ধ বন্ধ রাখত এবং সকলে এতে অংশগ্রহণ করত। এ সাময়িক যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যাওয়াকে ‘অলিম্পিকের যুদ্ধবিরতির নীতি’ বলা হত।

প্রাচীন গ্রীসে অলিম্পিক প্রতিযোগীতা; Image Source: World History Encyclopedia

তবে অলিম্পিক শুরুর ইতিহাস নিয়ে প্রাচীন লোককথাও প্রচলিত আছে।   বলা হয় দেবতা জিউস এবং তার পুত্র হারকিউলিস বা হেরাক্লিস এই গেইমের জনক। অলিম্পিক গেইমস এর প্রথম প্রতিযোগিতা ছিল দৌড় প্রতিযোগিতা।  এতে প্রথম হয় কোরিবাস নামক এক রাধুনি। সে সময়ে শুধুমাত্র পুরুষরা এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারত তাও নগ্ন হয়ে,  আর নারীদের অংশগ্রহণ ছিল নিষিদ্ধ।

আধুনিক যুগের অলিম্পিক :

প্রায় এক হাজার বছরের বেশি সময় ধরে গ্রীসে প্রাচীন অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়। এদিকে রোমান সাম্রাজ্য সময়ের সাথে অনেক শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ২১০ খ্রীস্টাব্দে গ্রীস রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায়। যিশুখ্রিষ্টের মৃত্যুর পর খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার প্রসার ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। রোমান সম্রাট প্রথম থিওসিডিসিসও খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন। যেহেতু অলিম্পিক অন্য ধর্মের রীতিনীতির মাধ্যমে পালিত হত তাই সম্রাট প্রথম থিওসিডিসিস অলিম্পিক খেলার উপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করেন এবং পরবর্তীতে সম্রাট দ্বিতীয় থিওসিডিসিস স্থায়ীভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন এতে বন্ধ হয়ে যায় হাজার বছর ধরে চলা অলিম্পিক প্রতিযোগিতা। ১৫০০ বছর পর ১৮২১ সালে গ্রীস অটোমান সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীন হয়। তখন থেকে গ্রীস আবার তাদের ঐতিহ্য ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। ১৮৩৩ সালে কবি প্যানাজিওটিস সটসস তার ‘ডায়লগ অব দি ডেড’ নামক কবিতায় অলিম্পিক পুনরায় জাগ্রত করার স্বপ্ন পোষণ করেন। ১৮৯২ সালে ফরাসি যুবক ব্যারেন পিয়ের দ্য কুবার্তিন অলিম্পিক গেইমসকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেন। দুই বছর পরে কুবার্তিন ৯ টি দেশের ৭৯ জন প্রতিনিধিকে নিয়ে একটি সভা করেন এবং সেখানে অলিম্পিক আবার নতুন ভাবে শুরু করার জন্য পরিকল্পনা করেন। পরবর্তীতে ১৮৯৬ সালে অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে এথেন্সের প্যানাথেসিয়াস স্টেডিয়ামে উদ্বোধন হয় প্রথম আধুনিক অলিম্পিক গেইমসের।

ব্যারেন পিয়ের দ্য কুবার্তিন; Image Sorce:Store Norske Leksikon

১৯২৪ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত অলিম্পিকের গ্রীষ্ম ও শীতকালীন প্রতিযোগিতা একই বছরে সম্পন্ন হত। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক অলিম্পিকস কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় অলিম্পিয়াডের প্রথম বছর গ্রীষ্মকালীন প্রতিযোগিতা হবে এবং তৃতীয় বছর শীতকালীন প্রতিযোগিতা হবে। এতগুলো বছরে শুধুমাত্র হাতেগোনা কয়েকবারই চার বছরের ব্যবধানে অলিম্পিক গেইমসের আসর বসতে পারে নি, তা হল ১৯১৬ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, কোভিড-১৯ প্যান্ডামিকের সময় জাপানে অনুষ্ঠিত হওয়া ২০২০ এর অলিম্পিক পিছিয়ে ২০২১ এ নেয়া হয়৷

মশাল প্রজ্জ্বলন:

অলিম্পিকের কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত হয় শিখা প্রজ্জ্বলনের অনুষ্ঠান। এথেন্স শুরু করে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দেশ ঘুরে মশাল পৌঁছে আয়োজক দেশের মূল স্টেডিয়ামে। আগুন জ্বালানো হয় মাটিতে রাখা একটি অবতল আয়না থেকে।  এতে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে এমন তাপের সৃষ্টি হয় যা থেকে মশাল জ্বালানো যায়। পুরো প্রক্রিয়াটি প্রাচীন রোমান রীতির সাদা পোশাক পরিহিত এগারো জন গ্রীক মহিলা সম্পন্ন করে থাকেন। এই এগারো জন মহিলার মধ্য থেকে একজন শিখা প্রজ্জ্বলন করে, অতপর তা থেকে অলিম্পিকের মশাল জ্বালিয়ে তুলে দেয়া হয় একজন ক্রীড়াবিদের হাতে। এছাড়াও একটি জলপাই গাছের শাখা তুলে দেয়া হয় এবং সাদা পায়রা উড়ানো হয় শান্তির প্রতীক হিসেবে। প্রাচীন অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জ্বলত একটি আগুনের শিখা, লোকগাথায় বলা হয়ে থাকে দেবতাদের রাজা জিউসের কাছ থেকে প্রমিথিউসের আগুন চুরি করে মানুষকে দিয়ে দেবার কাহিনির স্বারক হিসেবে এই শিখা  জ্বালানো হয়। বর্তমান অলিম্পিকের মশাল সেই ঐতিহ্যেরই ধারাবাহিকতা।

মশালের দৈর্ঘ্য ও ওজন একই থাকলেও কালে কালে এর উপকরণ বদলেছে।  উনিশশো আটচল্লিশ সালে লন্ডন অলিম্পিকে সাতচল্লিশ সেন্টিমিটার লম্বা ও নয়শো ষাট গ্রাম ওজনের মশাল তৈরি হয়েছিল অ্যালুমিনিয়াম ও হিডুমিনিয়ামের সংকর ধাতু দিয়ে। ছাপান্নতে সে উপকরণ বদলে হয়েছে অ্যালুমিনিয়াম- ম্যাগনেসিয়াম। এমনকি মশালের শিখাও তৈরি হয়েছে বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে। কখনো অলিভ অয়েল, প্রপিলিন বা হাইড্রোজেনের তরল গ্যাসে৷ উনিশশো আঠারো সাল থেকে অলিম্পিকের মশাল পুনরায় চালু হলেও, প্রাচীনকালের মত মশাল দৌড়ের রীতি আর ছিল না৷ উনিশশো ছত্রিশ সালে বার্লিন অলিম্পিকে নাৎসি জোসেফ গোয়েবলসের তত্ত্বাবধানে আবার অলিম্পিকে শুরু হয় মশাল দৌড়। গ্রীস থেকে বার্লিন তিন হাজার তিনশো একত্রিশ জনের দৌড়বিদের হাত হয়ে মশাল বার্লিনে পৌছায়। পরবর্তীতে মশালের এ বিশ্ব ভ্রমণ শুধু আর স্থলপথে সীমাবদ্ধ না থেকে জলপথ ও আকাশ পথেও নিয়ে যাওয়া হয়। অলিম্পিক দিনকে দিন যত জনপ্রিয় হয়েছে মানুষের কাছে, যত বেশি দেশ যুক্ত হয়েছে এই প্রতিযোগিতায়  তত বেশি বেড়েছে মশালের ভ্রমণপথ ও মশালবাহক। অলিম্পিকের রীতি অনুযায়ী আয়োজক দেশের মূল স্টেডিয়ামে মশাল দৌড় শেষ হলে অলিম্পিক কলড্রন বা বিশাল কড়াইয়ের মত অলিম্পিক মশালের আধারে আগুন জ্বালান বিখ্যাত কোনো ক্রীড়াবিদ। ২০২৪ এ

নগ্ন হয়ে খেলা কেন:

প্রাচীন অলিম্পিকে পুরুষদের নগ্ন হয়ে অংশগ্রহণের ব্যাখ্যা হিসেবে দুইটি মত প্রচলিত আছে। প্রথম মত হল,, ৭২০ সালে অরসিপস বা অরহিপস নামের মেগারার একজন দৌড়বিদ প্রথম দৌড় প্রতিযোগিতায় নগ্ন দৌড়ায়, কারণ দৌড়ানোর সময় তার পরনের কাপড় ছিড়ে যায়। অপর লোকগাথা হল, নগ্ন দৌড়ানোর রীতি এসেছে স্পার্তান রীতিনীতি থেকে। এই ব্যাপারে সঠিক প্রমাণ নেই যে অলিম্পিকের প্রথম স্ট্যাডিয়ন দৌড় প্রতিযোগিতার বিজয়ী দৌড়বিদ করইবসের পরণে কাপড় ছিল কিনা। কিন্তু অষ্টম শতাব্দীর শেষের দিকে পুরুষ প্রতিযোগিদের নগ্নতা একদম স্বাভাবিক হয়ে দাড়িয়েছিল।

প্রাচীন গ্রীসে পুরুষদের নগ্ন হয়ে অলিম্পিকে অংশগ্রহণ; Image Source: Wikimedia Commons

চার বছর পর পর কেন হয়:

প্রাচীন অলিম্পিক গেইমস অলিম্পিয়া নামক স্থানে প্রতি চার বছর পর পর অনুষ্ঠিত হত। এই চার বছর সময়কালকে অলিম্পিয়াড নামকরণ করা হয় যা দিনকাল গনণার কাজেও ব্যবহৃত হত। সময় তখন বছরের হিসেবে গণনা না করে, অলিম্পিয়াডের হিসাবে গণনা করা হত। মাঝের সময় খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ ও যাতে সব জায়গা থেকে মানুষ নির্দিষ্ট স্থানে একত্রিত হতে পারে সেজন্য সময় বরাদ্দ থাকত। প্রাচীনকালে যানবাহনের অপ্রতুলতার কারণে এক স্থান থেকে অপর স্থানে যাত্রা করে পৌঁছাতে অনেকদিন সময় লাগত। আধুনিক কালের অলিম্পিক গেইমসও প্রাচীন অলিম্পিক গেইমসের ঐতিহ্য বজায় রাখতে চার বছর পর পর আয়োজিত হয়।

২০২৪ অলিম্পিকস:

২৬ জুলাই ২০২৪ থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়েছে অলিম্পিক। এ বছর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে সিন নদীর পাশে জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে শুরু হয়েছে দ্যা গ্রেটেস্ট শো অন দ্যা আর্থ। প্যারিস অলিম্পিক টুর্নামেন্টে চারটে নতুন খেলা সংযোজিত হতে চলেছে। এই প্রথমবার অলিম্পিকে যুক্ত হচ্ছে ব্রেক ডান্স, স্কেট বোর্ডিং, সার্ফিং এবং স্পোর্টস ক্লাইম্বিং। ১৯০০ এর পর ১৯২৪ এবং তার ঠিক ১০০ বছর পর তৃতীয়বার প্যারিসে বসল বিশ্বক্রীড়ার সবচেয়ে বড় এ উৎসব।এবারের প্যারিস অলিম্পিকে উড়বে বাংলাদেশসহ ২০৬ দেশের পতাকা। ৩২ খেলার ৩২৯ ইভেন্টে নৈপুণ্য প্রদর্শন ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রচেষ্টায় নামবেন সাড়ে ১০ হাজার ক্রীড়াবিদ।


Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *